রিয়াজুল ইসলাম,
উপমহাদেশের আকাশে আবারও যুদ্ধের কালো মেঘ জমছে। ভারত ও পাকিস্তান—দুটি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ—এবার যেন সরাসরি সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপোড়েন, সামরিক প্রস্তুতির তৎপরতা, পারমাণবিক যুদ্ধের প্রকাশ্য হুমকি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির অস্থিরতা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ১৯৪৭, ১৯৬৫ কিংবা ১৯৭১ সালের মতো ভয়ঙ্কর সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
৪ আগস্ট চেন্নাইয়ের আইআইটি মাদ্রাজে এক ভাষণে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী সরাসরি সতর্ক করে বলেন, “দেশের পরবর্তী যুদ্ধ প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত শুরু হতে পারে, এবং তা মোকাবিলায় লাগবে পুরো জাতির সম্মিলিত শক্তি।” যদিও তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি, তবে বক্তব্যের প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ইঙ্গিত পাকিস্তানের দিকেই। দ্বিবেদী আরও বলেন, “পরেরবার যুদ্ধ আরও বড় হতে পারে, এবং শত্রু একা থাকবে না—কোনো না কোনো মিত্র দেশও পাশে থাকবে। তাই আমাদের সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
তিনি জানান, গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতির কৌশলগত পরিকল্পনা হাতে নেয়। সাম্প্রতিক সীমান্ত পরিস্থিতি ও সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করেই এই সতর্কতা জারি হয়েছে।
অন্যদিকে, ১১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় এক নৈশভোজে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির প্রকাশ্যেই ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তান যদি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, তবে আমরা বিশ্বের অর্ধেককে সঙ্গে নিয়েই ধ্বংস হব।” এছাড়া ভারতের সিন্ধুনদীর ওপর কোনো বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টা হলে তা মিসাইল হামলায় ধ্বংস করার ঘোষণা দেন। তার ভাষায়, “সিন্ধুনদী ভারতীয়দের পারিবারিক সম্পত্তি নয়, আমাদের অস্ত্রভাণ্ডারের কোনো অভাব নেই, আলহামদুলিল্লাহ।”
শুধু সেনাপ্রধান নন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও একই ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ১২ আগস্ট ইসলামাবাদে আন্তর্জাতিক যুব দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “ভারত যদি আমাদের পানি আটকে রাখার পরিকল্পনা করে, তবে এমন শিক্ষা দেওয়া হবে, যা তারা কখনো ভুলবে না।”
ভারত অবশ্য এসব বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, পাকিস্তানের এই ধরনের পারমাণবিক হুমকি দেওয়া মোটেও নতুন কিছু নয়, বরং এটি তাদের পুরোনো অভ্যাস। তিনি অভিযোগ করেন, “যুক্তরাষ্ট্র যখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেয়, তখনই তারা তাদের আসল রূপ দেখায়।” নয়াদিল্লি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, কোনো ধরনের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের কাছে তারা নতি স্বীকার করবে না এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ, যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কে বাণিজ্য সংকট, প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক সংকটময় পরিস্থিতিতে রয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মোদি সরকার হয়তো যুদ্ধকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইতে পারে, যেমনটা ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু করে থাকেন।
পাকিস্তানেও পরিস্থিতি শান্ত নয়। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সীমান্তে উত্তেজনা—সব মিলে দেশটি এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। এই পটভূমিতেই দুই দেশের সামরিক বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতির দিকে এগোচ্ছে, যা যে কোনো ভুল হিসাবের কারণে ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করছেন—এখনই যদি উভয় দেশ সংযম না দেখায় এবং কূটনৈতিক আলোচনার পথে না ফেরে, তবে দক্ষিণ এশিয়া এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে, যার প্রভাব কেবল দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং গোটা বিশ্বের ওপর পড়বে।