লক্ষ্মন রায় পঞ্চগড়
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা একটি অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। এই পূজায় দেবী দূর্গাকে পূজা করা হয়, যিনি শত্রুদের বিনাশকারী এবং শুভশক্তির প্রতীক। দুর্গাপূজা সাধারণত শারদীয় সময় উদযাপিত হয় এবং ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমীতে পাঁচ দিন ধরে চলে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা মূলত মন্দির ও পূজা মণ্ডপগুলোতে ব্যাপক আকারে পালিত হয়। মণ্ডপগুলোতে দেবীর প্রতিমা স্থাপন করা হয় এবং প্রতিদিনের আরতি,পূজা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। বিসর্জনের দিন, ভক্তরা দেবীকে বিদায় জানিয়ে নদী বা পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়।
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত একটি সনাতনী উৎসব। এটি সারা বিশ্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা পালিত হয়, তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, বিহার, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ (পূর্বাঞ্চল) এবং বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। এটি বাংলা বর্ষপঞ্জির আশ্বিন ও কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে অনজুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব,যার মধ্যে শেষ পাঁচটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।আশ্বিনের নবরাত্রির পূজা শারদীয় পূজা এবং বসন্তের নবরাত্রির পূজা বাসন্তিক বা বসন্তকালীন দুর্গাপূজা নামে পরিঅকালবোধন হল দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পূজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে তাই এই পূজার নাম হয় "অকালবোধন"। এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাস তার রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে।
সনাতম ধর্মের যেকোনো পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলি। দুর্গাপূজা মহাপূজা,(কারণ এতে মহাস্নান-পূজন-হোম-বলিদান - এই চারটি কর্ম জড়িত) এখানে পূজামন্ত্রের সঙ্গে শ্রীশ্রী চণ্ডীও পঠিত হয় । ঢাক-ঢোল-খোল-করতাল-শঙ্খ-ঘন্টা বাদ্যের সম্মিলিত ঐকতান, ধূপ-ধুনোর সুগন্ধী ধোঁয়া, ফুল-মালা-নৈবেদ্য-চন্দন-অগুরু-কস্তুরী-কর্পূরের মিলিত সুবাস, তার সাথে মন্ত্রোচ্চারণ ও মন্দ্রস্বরে চণ্ডীপাঠ এক ভাবগম্ভীর পবিত্র পরিবেশের সৃষ্টি করে। পূজায় প্রচলিত দেবী দুর্গার ধ্যানমন্ত্র:
"জটাজুটসমাযুক্তামর্দ্ধ্বেন্দুকৃতশেখরাম্।লোচনত্রয়সংযুক্তাং পূর্ণেন্দুসদৃশাননাম্।দুর্গাপূজায় যা যা লাগে তার মধ্যে প্রধানত রয়েছে মা দুর্গা ও তার চার সন্তানের প্রতিমা (কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী), পূজার বিভিন্ন সামগ্রী যেমন- ফুল, ধূপ দীপ, চন্দন, চিনেমাটির প্রদীপ, কুল, ফল, মিষ্টি, নৈবেদ্য, জল, ধূপকাঠি, সিঁদুর, ও হলুদ ইত্যাদি। এছাড়া, পূজার সময় মন্ত্র পাঠ ও আরতি করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়, তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম খুলনা, রাজশাহী, বরিশালসহ বড় শহরগুলিতে এর জমকালো আয়োজন দেখা যায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের পাশাপাশি বাংলাদেশের ত্রিপুরা,হাজং, বানাই, ওরাও, মাহাতো, পাত্র, কোচ, বর্মন, গঞ্জু, ডালু-সহ আরও বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষও পালন করে থাকেন।
২০২১ সালে সারা দেশে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২,১২২, যা ২০২২ সালে ৪৬টি বৃদ্ধি পেয়ে ৩২,১৬৮-এ দাঁড়ায়। ২০২৩ সালে সারাদেশে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে পূজামণ্ডপের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২,৪৬০। ২০২৪ সালে তা কমে ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।