এজিএম বাপ্পি ও তার মতো আড়ালের সাহসী যোদ্ধারা হারিয়ে যান পোস্টার-ব্যানারের ভিড়ে
রিয়াজুল ইসলাম, হাতিয়া প্রতিনিধি
হাতিয়া—বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। এই দ্বীপ শুধু ভৌগোলিক কারণে নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসেও বিশেষভাবে আলোচিত। বহু জাতীয় নেতা এ দ্বীপ থেকে উঠে এসে দেশকে দিয়েছেন আন্দোলন, সংগ্রাম আর মুক্তির নতুন ঠিকানা।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কেঁপে উঠেছিল দেশের রাজনৈতিক অচলায়তন। সেই উত্তাল আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলেন হাতিয়ার তিন সন্তান—হান্নান মাসুদ, তানভীর শরীফ ও এজিএম বাপ্পি। তিনজনই মাঠে-ময়দানে থেকে আন্দোলনকে করেছেন সমন্বয়, ছড়িয়ে দিয়েছেন শ্লোগান আর সংগ্রামের আগুন।
হান্নান মাসুদ ও তানভীর শরীফের নাম আজ পোস্টারে ভাসে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাদের প্রচারণা ঝলমল করে। কিন্তু এজিএম বাপ্পির মতো কর্মীরা হারিয়ে যান আলোচনার আড়ালে। অথচ আন্দোলনের সময় তিনি চট্টগ্রামে জেলার সহ-সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন, মহসিন কলেজ ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন এবং আন্দোলনকে শক্ত ভিত দিয়েছেন। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ফর ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগে মাস্টার্স করছেন তিনি। পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব হিসেবে। তাঁর গ্রামের বাড়ি হাতিয়ার খবির মিয়া গ্রামে।
কেন আলোচনায় আসেন না বাপ্পিরা? কারণ, তাদের পকেটে নেই কালো টাকা। নীতি ও আদর্শের রাজনীতি শিখে মাঠে নামা এই কর্মীরা প্রচার, ব্যানার কিংবা প্রচারণার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যান। বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতা হলো—যার যত বেশি অর্থ, সে-ই নেতা। এখানে সংগঠক হয়ে ওঠে ব্যবসায়ী, নীতি চাপা পড়ে চুক্তির নিচে। সৎ রাজনীতিকরা তাই আড়ালেই থেকে যান, কারণ তাদের পোস্টার ছাপানোর টাকাও থাকে না।
প্রশ্ন জাগে—এই গণঅভ্যুত্থান কি শেষ, নাকি এর শুরু? বাস্তবতা হলো, দেশের আনাচে-কানাচে এখনও হাজারো এজিএম বাপ্পি আছেন, যারা শোষণের পাহাড় ভাঙতে রাজপথে নামতে প্রস্তুত। তারা কালো টাকার পাহাড় গড়তে রাজি নয়, কিন্তু বুক চিতিয়ে রাজপথে দাঁড়াতে দ্বিধা করেন না।
লাল জুলাই তাই মনে করিয়ে দেয়—আড়ালের এই যোদ্ধারাই একদিন সামনে আসবেন। কারণ ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আগুন লুকিয়ে থাকে ছাইয়ের নিচে। কালো টাকার দম্ভ সাময়িকভাবে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যৎ বাঁচে মিছিলের শ্লোগান আর তরুণদের রক্তের দামে।
এজিএম বাপ্পির মতো নামহীন সাহসীরা প্রমাণ করেন—বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু লেনদেনের জন্য নয়, বরং ইতিহাস গড়ার জন্যও। তাদের গল্প বলা, তাদের সংগ্রামকে তুলে ধরা, এবং কালো টাকার রাজনীতিকে ভেঙে ফেলা এখন সময়ের দাবি।
হাতিয়ার খবির মিয়া গ্রামের বাপ্পি শুধু একজন নয়, বরং প্রতীক। সারা বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে আছেন আরও শত শত ‘বাপ্পি’, যাদের নাম হয়তো কোনো ব্যানারে লেখা হবে না, কিন্তু তারা বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের গোপন অধ্যায়ে।