বান্দরবানের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে বন্দীপরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে চমকে ওঠা তথ্যপর্যটন ও কৃষি উন্নয়ন ছাড়া মুক্তি কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা
মোঃ আবদুল্লাহ আল-মামুন,ক্রাইম রিপোর্টার
দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। যা মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি পার্বত্য জেলা বান্দরবানে, যেখানে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যের শৃঙ্খলে বন্দী। পরিকল্পনা কমিশনের সদ্য প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল মাল্টিডাইমেনশনাল পোভার্টি ইনডেক্স ফর বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৩৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ মানুষ (প্রায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। বিভাগভিত্তিক হিসাবে চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ। তবে জেলার হিসেবে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বান্দরবান, যেখানে দারিদ্র্যের হার ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি
বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি। পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ইন্টারনেট সংযোগসহ ১১টি সূচকের ভিত্তিতে এই পরিমাপ করা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিমত
বান্দরবানের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, পর্যটন শিল্পের পরিকল্পিত প্রসার, কৃষি ও শিক্ষা খাতে আধুনিকীকরণ এবং শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া এ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।
মানবাধিকার কর্মী ডনাইপ্রু নেলি বলেন, “প্রতি বছর সরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ দেয়, কিন্তু তার সঠিক ব্যবহার হয় না। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বরাদ্দের কার্যকারিতা কমে যায়। বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে বান্দরবানের দারিদ্র্য অনেকটাই লাঘব হতো।”
পর্যটন ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম মনে করেন, বান্দরবানকে ‘পর্যটনের শহর’ বলা হলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, “বছরে কয়েক মাস পর্যটক না আসায় স্থানীয় অর্থনীতিতে স্থায়ী উন্নয়ন ঘটছে না।”
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অংচমং মার্মা বলেন, “অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিছুটা হলেও হয়েছে, কিন্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার হলে চিত্র ভিন্ন হতে পারত।”
বান্দরবান হোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দীন বলেন, “সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো কাজ করলেও প্রান্তিক মানুষ তাদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই দারিদ্র্য কমছে না।”
প্রশাসনের মন্তব্য
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, “বান্দরবানে এখনো বহু মানুষ দারিদ্র্যের সীমার নিচে বসবাস করছে। পূর্বে বরাদ্দের সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এ বছর জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কৃষি ও পর্যটন খাতকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।”
উপসংহার
প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে, দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় বান্দরবান ভয়াবহ দারিদ্র্যের বোঝা বইছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়নি। স্থানীয়রা মনে করছেন, পর্যটন খাতকে পরিকল্পিতভাবে সমৃদ্ধ করা, কৃষিকে আধুনিকীকরণ ও শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবার প্রসার ঘটানো ছাড়া বান্দরবানের দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব নয়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বরাদ্দকৃত অর্থ স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করলে পার্বত্য এই জেলার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষও দারিদ্র্যের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেতে পারে।