চায়ের কাপেই আত্মনির্ভরতার গল্প — আবেদা সুলতানা রেশমা
এম এ মান্নান,স্টাফ রিপোর্টার,নিয়ামতপুর (নওগাঁ)
উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরি হারিয়ে ভেঙে পড়েননি। নিজের উদ্যোগে চায়ের দোকান খুলে বুনছেন নতুন জীবনের স্বপ্ন।নওগাঁ শহরের জেলখানার সামনের ব্যস্ত রাস্তায়, পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট দোকান। বাইরে ঝুলছে একটি সাধারণ সাইনবোর্ড—কোনো ঝলমলে সাজসজ্জা নেই, নেই জমকালো বিজ্ঞাপন। তবুও দোকানটির চারপাশে দিনের বেশিরভাগ সময় জটলা লেগে থাকে। এখানে চা পান করতে আসা ক্রেতারা শুধু চা নয়, পান করেন প্রেরণার এক বিশেষ স্বাদ। এই দোকানের মালিকই হলেন আবেদা সুলতানা রেশমা—যার জীবন কাহিনী অনেকের জন্যই সাহসের পাঠ।রেশমা একসময় ছিলেন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ের হিসাব শাখার একজন কর্মী। বিএ পাস করার পরই পেয়েছিলেন চাকরির সুযোগ, যদিও সেটি ছিল চুক্তিভিত্তিক। ৯ বছরের দীর্ঘ সময় তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে আর কোনো চাকরির সুযোগ হলো না।”চাকরি শেষ হয়ে গেলেও জীবন তো শেষ হয়নি,”—নিজেকে এভাবেই বোঝালেন রেশমা। অন্য অনেকের মতো তিনি ঘরে বসে থাকেননি বা হতাশায় ভেঙে পড়েননি। বরং ভেবেছেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে কিছু একটা করতেই হবে।
পুঁজি সীমিত, তবুও মনোবল ছিল অটুট। তাই তিনি ঠিক করলেন—একটি ছোট্ট চায়ের দোকান দেবেন। শহরের জেলখানার সামনে, পাসপোর্ট অফিসের পাশের একটি জায়গা ভাড়া নিয়ে শুরু করলেন নতুন পথচলা। প্রথম দিন দোকানে ছিল কয়েকটি কেতলি, কিছু কাপ, বিস্কুটের কৌটা আর একমুঠো সাহস।সকালে দোকান খোলার সময় দেখা যায় তিনি নিজেই পানি গরম করছেন, চা তৈরি করছেন, আবার হাসিমুখে ক্রেতাদের স্বাগত জানাচ্ছেন।তার দোকানে শুধু চা পান করার জন্যই নয়, গল্প করতেও আসে মানুষ। কেউ জানতে চায় তার পুরনো চাকরির দিনের কথা, কেউ আবার কেবল মুগ্ধ হয় তার দৃঢ় মনোবলে। অনেকেই বলেন, রেশমা দেখিয়ে দিয়েছেন—সম্মানজনক জীবনের জন্য সরকারি চাকরি বা বড় ব্যবসা জরুরি নয়, সৎ উপার্জনই সবচেয়ে বড় সম্মান।তিনি বলেন—“এই দোকান আমার স্বাধীনতা, আমার আত্মমর্যাদা।চাকরি হারানোর পর অনেকেই ভেঙে পড়েন, কিন্তু রেশমা ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, সম্মানজনক জীবন শুধু সরকারি চাকরির মাধ্যমেই নয়, সৎ উপার্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। সমাজের নারীদের জন্য তিনি একটি জীবন্ত উদাহরণ—যে নারীরা মনে করেন সুযোগ না পেলে তারা কিছু করতে পারবেন না, তাদের জন্য রেশমা যেন এক অনুপ্রেরণার বাতিঘর।আজও তিনি তার চায়ের দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের পরিশ্রম ও দৃঢ়তার জোরে। ভবিষ্যতে দোকানটি বড় করার স্বপ্নও দেখেন। তার মতে—”জীবন সংগ্রামের নাম, আর সংগ্রাম মানেই হাল না ছাড়া।”এখানে কারো কাছে হাত পাততে হয় না—এটাই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।”রেশমা চান তার দোকানটি আরও বড় হোক, সেখানে বসার ভালো ব্যবস্থা হোক, যেন ক্রেতারা আরাম করে বসে চা পান করতে পারেন। তিনি জানেন, পথ সহজ নয়, কিন্তু বিশ্বাস করেন—অধ্যবসায় থাকলে অসম্ভব বলে কিছু নেই।প্রতিটি কাপ চায়ের সঙ্গে আবেদা সুলতানা রেশমা পরিবেশন করেন শুধু স্বাদ নয়, দেন এক মুঠো সাহস, এক চিমটি স্বপ্ন, আর অসীম আত্মবিশ্বাস।