২ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি
এম,এ,মান্নান, স্টাফ রিপোর্টার,নিয়ামতপুর (নওগাঁ)
বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু কিছু দিন শুধুমাত্র একটি ঘটনার কারণে নয়, বরং একটি চেতনার প্রতীক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। ২ আগস্ট তেমনই একটি দিন, যা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ, আত্মত্যাগ ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হয়ে উঠেছে। এ দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ন্যায়বিচার, সমতা এবং মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে কোনো আপস চলে না। সমাজে চলমান বৈষম্য, নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ এই দিনটিকে স্মরণীয় করে তুলেছে।বৈষম্য বলতে সাধারণভাবে বোঝায়—কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে কম সুযোগ, সুবিধা বা অধিকার দেওয়া। বাংলাদেশে এই বৈষম্য বহুরূপে বিদ্যমান—ধর্মীয়, জাতিগত, অর্থনৈতিক, লিঙ্গভিত্তিক কিংবা ভৌগোলিক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গ ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রায়শই এই বৈষম্যের শিকার হন।শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, আইনের সুরক্ষা এমনকি ন্যূনতম সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও অনেকেই পিছিয়ে পড়েন। এর পেছনে যেমন রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার ও মানসিকতার ঘাটতি, তেমনি রয়েছে প্রশাসনিক অবহেলা ও আইনি দুর্বলতা।
২ আগস্ট একটি প্রতীকী দিন হিসেবে উদযাপন করা হয় সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা ও প্রতিবাদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। এই দিনে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, শিক্ষার্থী, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এই দিনের মূল প্রতিপাদ্য থাকে—”সমতার সমাজ চাই, বৈষম্যের অবসান চাই।”
বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা যেমন—সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, নারী ও শিশু নির্যাতন, বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ, আদিবাসীদের জমি দখল—এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা হয় এই দিনে। মূলত, ২ আগস্টকে ঘিরে একটি সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়, যা কেবল একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং বছরের অন্যান্য সময়েও প্রভাব বিস্তার করে।এই দিনটিতে দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে মিছিল, মানববন্ধন, পথসভা, পোস্টারিং, দেয়াল লিখন, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এতে অংশ নেন শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, সমাজকর্মী এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।আন্দোলনটি পুরোপুরি অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ পন্থায় পরিচালিত হয়। অংশগ্রহণকারীরা বৈষম্যের শিকার মানুষের কথা তুলে ধরেন, দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিদের সম্মান জানান, এবং প্রশাসনের প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান জানান।২ আগস্টের আন্দোলন শুধুই প্রতীকী নয়, বরং এর রয়েছে স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত কিছু দাবি, যেমন—ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ও ভাষার ভিত্তিতে বৈষম্য বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ।শিক্ষা, চাকরি ও চিকিৎসা সেবায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সুরক্ষা দেওয়া।নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর বিচার নিশ্চিত করা।পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সহায়তা ও ক্ষমতায়নের উদ্যোগ গ্রহণ।বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী নীতি গ্রহণ। ২ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরাসরি রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দিতে না পারলেও, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী চেতনার জন্ম দিয়েছে। আজকের প্রজন্ম আরও বেশি সচেতন, সোচ্চার ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হচ্ছে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এখন বৈষম্যের ঘটনার বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়।রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য কমানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে, যেমন—ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সহায়তা, প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ইত্যাদি। যদিও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, কিন্তু ২ আগস্ট আন্দোলন আমাদের সামনে আলোর দিশা দেখায়।২ আগস্ট কেবল একটি স্মৃতিচারণের দিন নয়, এটি আমাদের বিবেক জাগ্রত করার দিন। এই দিনে আমরা শপথ নিই—কোনো মানুষ যেন কেবল তার ধর্ম, জাতি, ভাষা বা আর্থিক অবস্থার কারণে অবহেলিত না হয়। আমরা চাই একটি বৈষম্যহীন, মানবিক সমাজ—যেখানে প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে সমান অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগ।এই দিনটির শিক্ষা হলো—”চুপ করে থাকলে চলবে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখতে হবে।” আর এই চেতনাই ২ আগস্টের প্রকৃত সফলতা।