জলবায়ু পরিবর্তনের করাল ছায়া: কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ভয়াবহ ভাঙন
এম কে হাসান
বিশেষ প্রতিবেদক
কক্সবাজার
বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস, অনিয়ন্ত্রিত পাহাড় কাটা এবং বৃক্ষ নিধনের ফলে সৈকতের বিস্তীর্ণ অংশে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অন্তত ৩.৫ কিলোমিটার এলাকা সাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষত সুগন্ধা, লাবণী, ও কলাতলি পয়েন্টে ভাঙনের তীব্রতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলছে হিমবাহ, যার ফলে সমুদ্রের পানির পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে জলোচ্ছ্বাস, ঢেউয়ের গতি ও শক্তি। এর ফলে সৈকতের বালুকাময় প্রাকৃতিক প্রাচীর ভেঙে যাচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত গতিতে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, সৈকতের ভাঙনের ফলে প্রতি বছর কোটি টাকার স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পর্যটক সংখ্যা কমছে। স্থানীয় এক হোটেল মালিক বলেন, “যেখানে এক সময় পর্যটকে ভরে যেত সৈকত এলাকা, সেখানে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।”
স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবিদরা এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “প্রকৃতির সাথে যদি যুদ্ধ করা হয়, তাহলে জয়ের সম্ভাবনা নেই। একমাত্র টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমেই উপকূল রক্ষা সম্ভব।”
কক্সবাজার শহর ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটার ফলে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এ অঞ্চল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য ইটভাটা ও যানবাহনের অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া-যা শহরের বাতাসকে করে তুলেছে অস্বাস্থ্যকর ও বিষাক্ত।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিগত এক বছরে কক্সবাজার সদর, রামু ও টেকনাফ উপজেলায় ৮৩টি অবৈধ পাহাড় কাটার অভিযোগে বন বিভাগ অভিযান পরিচালনা করলেও অনেকাংশেই তা বন্ধ করা যায়নি। স্থানীয় ভাবে প্রভাবশালী কিছু মহল পাহাড় কাটার সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ৩৬ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। কালো ধোঁয়ার মূল উৎস হলো অবৈধ ইটভাটা, ডিজেল চালিত যানবাহন এবং প্লাস্টিক পোড়ানো।
এ অঞ্চলের শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও চর্মরোগে ব্যাপক ভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরের এক চিকিৎসক বলেন, “আমাদের চেম্বারে প্রতিদিন গড়ে ১০০+ শ্বাসতন্ত্র রোগে আক্রান্ত রোগী আসছেন, যার ৭০% পরিবেশগত কারণে।”
পাহাড় কাটার ফলে মাটি হারাচ্ছে তার ধারণ ক্ষমতা, সৃষ্টি হচ্ছে ভূমি ধ্বস ও ফাটল। ২০২৫ সালের জুনে রামু উপজেলায় পাহাড় ধসে দুই শিশুর প্রাণহানি হয়েছে। স্থানীয়দের মতে, পাহাড় ও বনই ছিল প্রাকৃতিক ভারসাম্যের আশ্রয়, তা ধ্বংস করে নিজেদের জন্যই বিপদ ডেকে আনছি।