ঐতিহাসিক কুশুম্বা মসজিদ – একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শন
এম,এ,মান্নান, স্টাফ রিপোর্টার,নিয়ামতপুর (নওগাঁ)
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এসব নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম এক গৌরবময় নাম হলো কুশুম্বা মসজিদ। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে এটি বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্য ইতিহাসে এক অনন্য নিদর্শন। মসজিদটি শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং সুলতানি আমলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শৈল্পিক উৎকর্ষের এক জীবন্ত সাক্ষ্য।কুশুম্বা মসজিদ অবস্থিত নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার কুশুম্বা গ্রামে, ছোট যমুনা নদীর তীরে। নদীর নিকটবর্তী হওয়ার কারণে মসজিদের পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম ও নান্দনিক। এটি একটি গ্রামীণ জনপদের নিভৃত প্রান্তে অবস্থিত হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এটি আজ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।এই ঐতিহাসিক মসজিদটি নির্মিত হয় ১৫৫৮-৫৯ খ্রিষ্টাব্দে (৯৬৫ হিজরি)। নির্মাণকাল ছিল আফগান শাসক শূর বংশীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ-এর শাসনামল। স্থানীয়ভাবে মনে করা হয়, তৎকালীন এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা রাজা সুফি হায়দার আলী বা রাজা সুলায়মান এর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর ইবাদতের জন্য এবং জনগণের কল্যাণে এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।কুশুম্বা মসজিদ বাংলার মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো— মসজিদটি সম্পূর্ণভাবে কষ্টিপাথরের তৈরি। এমন পাথরের নির্মাণ বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে বিরল। মসজিদের দেয়ালগুলো প্রায় ৭ ফুট পুরু, যা একে ভূমিকম্প বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হয়েছিল।মসজিদের মোট আয়তন প্রায় ৫৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪২ ফুট প্রস্থ। এতে রয়েছে ছয়টি গম্বুজ, এবং চারকোণে রয়েছে চারটি অষ্টভুজাকৃতির সুউচ্চ মিনার। দেয়াল ও দরজার উপর রয়েছে চমৎকার কারুকাজ। দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে কোরআনের আয়াত খোদাই করে লেখা হয়েছে, যা ইসলামি শিল্পকলার নিদর্শন।মসজিদের ভেতরে রয়েছে একটি মেহরাব এবং খুৎবার জন্য বিশেষ জায়গা। ভেতরের পরিবেশ অত্যন্ত পবিত্র ও আধ্যাত্মিক।১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ শাসনের আগমনে অনেক ইসলামি স্থাপনার মতো কুশুম্বা মসজিদও উপেক্ষিত হয়। এমনকি একটি বড় ভূমিকম্পে এর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূল কাঠামো অক্ষত থাকে। স্থানীয় মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশীলনের পাশাপাশি এটি হয়ে ওঠে ইতিহাস সচেতন মানুষের কাছে এক বিশেষ তীর্থভূমি।বর্তমানে মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত। এটি পর্যটন স্পট হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। প্রতি শুক্রবার ও ঈদে এখানে জুমা ও ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মানুষ এই মসজিদকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার চোখে দেখে।ঐতিহাসিক কুশুম্বা মসজিদ শুধু একটি মসজিদ নয়; এটি বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অংশ। মুসলিম স্থাপত্য, শিল্প এবং ধর্মীয় চেতনার এক অপূর্ব সম্মিলন দেখা যায় এর গাঁথুনিতে। সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কুশুম্বা মসজিদ আজও দাঁড়িয়ে আছে, বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক নীরব সাক্ষী হয়ে। আমাদের দায়িত্ব এ ধরনের স্থাপত্য সম্পদকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর গুরুত্ব বোঝানো।