পুলক শেখ
সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের এক টকশোতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা ও আলেমদের রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে তীব্র আলোচনা জাতীয় পর্যায়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। টকশোতে অংশ নেন কওমি ধারার দুই আলেম—রফিকুল ইসলাম মাদানী ও ইবনে নুরুল ইসলাম এবং অ্যাক্টিভিস্ট আসিফ আদনান।
আলোচনার এক পর্যায়ে ইলিয়াস হোসাইন সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, যা দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
ইলিয়াস বলেন, “কবে হুজুরদের হাতে রাষ্ট্র তুলে দিলে তারা তা চালাতে পারবে? তাদের তো দাওরা হাদীস ছাড়া আর কোনো শিক্ষা নেই। তারা অর্থনীতি বোঝেন না, ভূগোল জানেন না, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝেন না, আধুনিক রাষ্ট্রনীতির কোনো ধারণা নেই।” এই প্রশ্ন কেবল চ্যালেঞ্জ নয়, কওমি শিক্ষার বর্তমান সীমাবদ্ধতার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে।
জবাবে রফিকুল ইসলাম মাদানী বলেন, “কুরআন-হাদীসে অর্থনীতির কথা আছে।” কিন্তু উপস্থাপক যখন জানতে চান, “কুরআনের কোথায় অর্থনীতির কথা আছে?”—তখন তিনি কোনো নির্দিষ্ট আয়াত বা দলিল পেশ করতে পারেননি।
লাইভ সম্প্রচারে এই মুহূর্তটি স্পষ্ট করে যে, আধুনিক জ্ঞান ও বাস্তব বিশ্লেষণে কওমি আলেমদের প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এই ঘটনা কওমি শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তুলেছে।
আলোচনায় আরও বলা হয়, “কওমি আলেমরা ইংরেজিকে হারাম মনে করেন। আধুনিক শিক্ষা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিলে দেশ অচল হয়ে যাবে।” এই ধরনের ধারণা এখন শুধু মিডিয়ায় নয়, সাধারণ মানুষের মনেও গড়ে উঠছে।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা দেখলে বোঝা যায়, একজন শিক্ষার্থী ১৪-১৫ বছর ধরে দাওরা হাদীস পর্যন্ত পড়ে ইসলামি ফিকহ, হাদীস, তাফসীর ও আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু এই সময়ে রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞান বা মৌলিক ইংরেজির শিক্ষা তারা পান না। ফলে বাজেট প্রণয়ন, বৈদেশিক চুক্তি বোঝা বা আধুনিক প্রশাসনের জটিল বিষয়ে তাদের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ।
অথচ কুরআন ও হাদীসে অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সমাজ ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা রয়েছে। হযরত ইউসুফ (আ.) মিশরের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) প্রশাসন ও বিচারে যুগান্তকারী সংস্কার এনেছিলেন। তাঁরা ওহির পাশাপাশি যুগের বাস্তবতা ও কৌশল বুঝতেন। আজকের আলেমদেরও আধুনিক জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার এখন জরুরি। ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি, গণিত, ভূগোল, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় যুক্ত করা দরকার। এগুলো ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং আধুনিক বিশ্বে ইসলামের বাণী ছড়াতে সহায়ক। আলেমদের আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তির ভাষায় কথা বলতে হবে, মিডিয়ায় সপ্রতিভভাবে নিজেদের তুলে ধরতে হবে।
কওমি শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য শুধু মসজিদের ইমামতি নয়, রাষ্ট্র ও সমাজে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। এর জন্য দরকার এমন শিক্ষা ব্যবস্থা, যা কুরআন-হাদীসের আলোকে গড়ে উঠবে এবং আধুনিক জ্ঞানে পরিপূর্ণ হবে।