মোঃ কামাল উদ্দিন স্টাফ রিপোর্টার
চট্টগ্রামের পটিয়ার( শোভনদন্ডী) কৃতিসন্তান আব্দুল গফুর হালী , আঞ্চলিক ও মরমী ধাঁচের গানে আবদুল গফুর হালী একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তার লেখা ও সুরে বহু গান সময়ের গণ্ডি জয় করে মানুষের মনে জায়গা নিয়ে আছে। যেমন- ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা , রসিক তেল কাজলা কোন পাঞ্জাবিওয়ালা’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলগো তুই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই ‘অ শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও বানুরে অ বানু আঁই যাইয়ুমু রেঙ্গুন শরত্/ তোঁয়ার লাই আইন্যুম কী’ ইত্যাদি। এছাড়া ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে , দুই কুলের সোলতান , ‘কতো খেলা জানরে মাওলা’ ইত্যাদি মাইজভাণ্ডারি ঘরানার গানও তারই সৃষ্ট।
আঞ্চলিক গানে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল চট্টগ্রাম। গানের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছেন আসকর আলী পণ্ডিত, মৌলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, বজলুল করিম, মন্তাকীনি, রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাসির, মলয় ঘোষ দস্তিদার, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্ত্তী ও মোহন লাল দাশেরা। তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরী হলেন আবদুল গফুর হালী।
আবদুল গফুর হালীর জন্ম ১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদে। তার পিতার নাম আবদুস সোবহান এবং মাতার নাম গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর একাডেমিক শিক্ষার ইতি টানেন।
সঙ্গীতে আবদুল গফুর হালী একজন বিস্ময়কর মানুষ বটে। নির্দিষ্ট কোনো গুরু কিংবা শিক্ষকের কাছে তিনি গান শেখেননি। বরং চট্টগ্রামের মাটি হতে তিনি গান শেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, আস্কর আলী পণ্ডিত ও রমেশ শীলের গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। গ্রামে যাত্রাদলের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। হতো পালা গান, গাজীর গান। পুঁথিপাঠের আসর বসত ঘরে ঘরে। এসব আসরের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন শিশু গফুর।
অল্প বয়সে সিনেমা দেখার প্রতি দারুণ আগ্রহ জন্মায় আবদুল গফুর হালীর। চট্টগ্রামের রঙ্গম সিনেমা হলে সিনেমা দেখতেন। আর সেসব সিনেমার গান আয়ত্ব করে গাইতেন একেবারে হুবহু!
গানের প্রতি গফুর হালীর আগ্রহ এবং তার গায়কীর সুনাম ছড়িয়ে গেলো গ্রামে। যার ফলে একদিন তাকে যাত্রা অনুষ্ঠানের মঞ্চে তুলে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে তিনি গান করলেন। তার গান শুনে সবাই প্রশংসা করলেন। তবে গফুরের বাবা এসব পছন্দ করতেন না। গফুর হালীর মাথা থেকে গানের চিন্তা নামানোর জন্য তাকে করিয়ে দেন বিয়ে। তখন তার বয়স মাত্র ২২-২৩ বছর।
বাবা ভেবেছিলেন, বিয়ে দিলে হয়তো ছেলে সংসারী হবে। হলো উল্টো। বিয়ের পর বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আবদুল গফুরও। টুকটাক আয়-রোজগারও করছিলেন। বাবার পুরনো ব্যবসাটা রপ্ত করে নিচ্ছিলেন। এ সময় একদিন আচমকা হাজির হলেন ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডারে। এখানেও গানের টান। রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দকিনি, মৌলানা হাদীর মাইজভাণ্ডারি গান তার মনোজগত বদলে দেয়। লাল পোশাক পরা লোকজন যখন মাইজভাণ্ডারে ঢোল বাজিয়ে গাইতেন, তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারতেন না। তাদের সঙ্গে গলা মেলাতেন। একদিন মাইজভাণ্ডারের ভক্তদের অনুরোধে গাইতে হলো আবদুল গফুরকে। সেই থেকে তার মনে চরমভাবে আসন ঘেঁড়ে বসে আধ্যাত্মিক সাধনা।
গফুর হালী মূলত সহজাত কবি, সঙ্গীতশিল্পী। নিজের রচিত অধিকাংশ গানে সুরারোপও করেছেন তিনি নিজেই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান রচনায় এখনও কেউ আবদুল গফুর হালীকে অতিক্রম করতে পারেননি। এজন্য তাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের একচ্ছত্র সম্রাট বলা হয়। ৬০ বছর ধরে টানা গান লিখেছেন আবদুল গফুর হালী। তার লেখা আঞ্চলিক গানের সংখ্যা ১ হাজার ৬০৭টি এবং মাইজভাণ্ডারি গান ১ হাজার ১২০টি।
১৯৬৩ সাল থেকে বেতারে আবদুল গফুর হালীর লেখা গান প্রচার শুরু হয়। তবে প্রথম সাত-আট বছর তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। গান প্রচার হতো ‘সংগ্রহ’ হিসেবে। কারণ, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তখনও তালিকাভুক্ত হননি গফুর হালী। ১৯৭২ সালে তালিকাভুক্ত হন তিনি। এরপর শ্রোতারা অবাক হয়ে শুনলেন, বেতারের অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা গফুর।
সত্তর ও আশির দশক ছিল আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারি গানের স্বর্ণযুগ। তার লেখা সাড়া জাগানো বেশির ভাগ গান বিভিন্ন শিল্পীর গ্রামোফোন রেকর্ডে বেরিয়েছিল। তার গান গেয়ে অনেক শিল্পী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শ্যাম-শেফালীর অনেক স্মরণীয় গানের স্রষ্টা আবদুল গফুর হালী।
শুধু গান নয়, নাটকেও আবদুল গফুর হালীর বিচরণ ছিল। তিনিই চট্টগ্রামের ভাষায় প্রথম লোকনাটকের রচনা করেছিলেন। তিনি মোট সাতটি আঞ্চলিক নাটক রচনা করেন। এর মধ্যে ‘গুলবাহার’ গীতিনাট্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চায়িত ও বেতার-টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। তার রচিত অন্য নাটকগুলো হচ্ছে- ‘আজব সুন্দরী নীলমণি কুশল্যা পাহাড় চাটগাঁইয়া সুন্দরী সতী মায়মুনা’ এবং ‘আশেক বন্ধু।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আবদুল গফুর হালীর সৃষ্টিশীলতার নাম ছড়ায় বিদেশেও। জার্মানীর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গান নিয়ে গবেষণাকর্ম করছেন একদল লোকগবেষক। জার্মান ভাষায় তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র। ২০০৪ সালে হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হান্স হার্ডার গফুর হালীর ৭৬টি গান জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ‘ডর ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ বা ‘পাগলা গফুর বলে’ শিরোনামে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।
বর্ণাঢ্য জীবনে আবদুল গফুর হালী বেশ কয়েকটি জাতীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রাহে ভাণ্ডার সম্মাননা পদক- ২০১২, চট্টগ্রাম সমিতি পদক- ২০১২, বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ- ২০১৩, সুখেন্দু স্মৃতি নাট্যপদক- ২০১৩, জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা- ২০১৩।