আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন পদ্ধতি (Proportional Representation)
বিশ্বের বহু দেশের গৃহীত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা
✍️ মোঃ সোহেল মিয়া
স্টাফ রিপোর্টের
গণতন্ত্র মানেই জনগণের শাসন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি কতটা সঠিকভাবে জনগণের সেই অভিপ্রায়কে প্রতিফলিত করছে? ঠিক এই জায়গা থেকেই গুরুত্ব পাচ্ছে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Representation (PR) নির্বাচন পদ্ধতি।
গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে একটি কার্যকর, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। এমনই একটি নির্বাচন পদ্ধতি হলো Proportional Representation (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি, যা বিশ্বের বহু দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার অন্যতম আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
PR নির্বাচন পদ্ধতি কী?
PR বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন পদ্ধতি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা যত শতাংশ ভোট পায়, সেই অনুপাতে তারা সংসদ বা আইনসভায় আসন পায়।
উদাহরণ: যদি একটি রাজনৈতিক দল ৩০% ভোট পায়, তাহলে সংসদে তার আসনও হবে মোট আসনের ৩০%। ফলে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র—সব দলের প্রতি ন্যায্যতা বজায় থাকে।
বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪ % দেশে, পিআর ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
উন্নত দেশের সংগঠন ওইসিডি’র ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০% দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
🌐 বিশ্বের কোন কোন দেশে PR পদ্ধতি প্রচলিত?
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯১টির বেশি দেশ পুরোপুরি বা আংশিক ভাবে PR নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো:
🇩🇪 জার্মানি 🇸🇪 সুইডেন 🇳🇱 নেদারল্যান্ডস 🇧🇪 বেলজিয়াম৷ 🇳🇿 নিউজিল্যান্ড 🇮🇱 ইসরায়েল 🇿🇦 দক্ষিণ আফ্রিকা 🇨🇭 সুইজারল্যান্ড৷ 🇫🇮 ফিনল্যান্ড
🇳🇴 নরওয়ে
📊 PR পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:
১। বস্তুনিষ্ঠ ও ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব: জনগণের প্রকৃত মতামত অনুযায়ী আসন বরাদ্দ হয়।
2। ক্ষুদ্র ও সংখ্যালঘু দলের সুযোগ: ছোট দলগুলোর জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
৩। ভোটের অপচয় কম: ভোট যে দলের পক্ষেই পড়ুক, তা অন্তত প্রতিনিধিত্বে প্রতিফলিত হয়।
৪। রাজনৈতিক বৈচিত্র্য: একক দলভিত্তিক নয় বরং নীতিনির্ভর সমঝোতার মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়।
৫। গঠনমূলক বিরোধী দল গঠনের পরিবেশ: কারণ দলগুলো বিরোধীতার পাশাপাশি গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নিতে পারে।
🇧🇩 বাংলাদেশের প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি:
বর্তমানে বাংলাদেশে “ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP)” পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একক আসনে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীই নির্বাচিত হন, যদিও তিনি ৪০ %-এর কম ভোট পাইলেও।
এর কিছু সীমাবদ্ধতা:
অনেক সময় সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচিত হলেও, ৭০ % ভোট বিকল্প প্রার্থীর পক্ষে পড়ে থাকে।
সংখ্যালঘু দলের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ভোটের অনেক অংশ বাস্তবে প্রতিনিধিত্ব পায় না।
এককদলীয় আধিপত্য গড়ে উঠার ঝুঁকি বাড়ে।
বাস্তব উদাহরণ :
ধরা যাক, চারটি দল একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একজন প্রার্থী ৩০% ভোট পাইলো অন্য দিকে বাকিরা মিলে ৭০ % ভোট পাইলো , প্রচলিত পদ্ধতিতে সেই ৩০ % ভোট প্রাপ্ত প্রার্থীই জয়ী হবে। অর্থাৎ ৭০% ভোটের কোনো কার্যকর প্রতিনিধিত্ব থাকবে না এবং এই ৭০ % ভোটের কোন মূল্যায়ন হয় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে PR পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা :
বর্তমানে দেশে রাজনীতিতে নতুন মত, চিন্তা ও নেতৃত্বের আবির্ভাব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মূলত নির্বাচন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতায়। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন চালু হলে জাতীয় রাজনীতিতে গঠনমূলক আলোচনা, গণতান্ত্রিক চর্চা এবং শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের পথ উন্মুক্ত হতে পারে।