এমপিও নামক সোনার হরিন,শিক্ষকদের আত্মবঞ্চনার করুন দৃশ্য
এম,এ,মান্নান, স্টাফ রিপোর্টার (নওগাঁ) প্রতিনিধি,দৈনিক প্রভাতী বাংলাদেশ
মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় যাঁদের, তাঁরা হচ্ছেন শিক্ষক। জাতি গঠনের মূলভিত্তি হলো শিক্ষাব্যবস্থা, আর সেই ব্যবস্থার চালিকাশক্তি শিক্ষক সমাজ। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে আসার পরেও বাংলাদেশের অগণিত বেসরকারি শিক্ষক এমপিওভুক্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। আজও “এমপিও” নামক সোনার হরিণের পিছনে দৌড়াতে গিয়ে তাঁদের অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে— এটাই কি মানবতা?এমপিও (Monthly Pay Order) হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত একটি আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি, যার আওতায় নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। এটি কেবল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁদের পেশাগত স্বীকৃতিও।
এমপিওভুক্তির মাধ্যমে একজন শিক্ষক—
সরকারি স্কেলে বেতন পান পেনশন, উৎসব ভাতা, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি সুবিধা পান জীবনের ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতে পারেন সামাজিক মর্যাদার অংশীদার হতে পারেন বাংলাদেশে আজও প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। তারা নামমাত্র বেতন (মাসে ২-৪ হাজার টাকা) নিয়ে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের ঠিকমতো বেতনই দেয় না, শিক্ষকদের বলতে হয়, “ছাত্রের কাছ থেকে যা ওঠে, তা দিয়েই চালাতে হয়।” একদিকে দায়িত্বপূর্ণ পেশা, অন্যদিকে দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন— এই বৈপরীত্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।অনেক প্রতিষ্ঠান ৮-১০ বছর ধরে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে, হাজারো শিক্ষার্থী তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করছে, অথচ সরকার কোনো এমপিও দিচ্ছে না। আবেদনের পর আবেদন, বারবার তথ্য জমা দেওয়া— তবু মিলছে না কোনো সাড়া। এই দীর্ঘসূত্রিতা শিক্ষক সমাজকে শুধু হতাশই করছে না, ধ্বংস করছে তাঁদের পেশাগত স্বপ্ন।
কেবল বঞ্চিত নয়, শিক্ষকরা বহুবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।দীর্ঘ অনশন,অবস্থান কর্মসূচি,পত্রপাঠ ঘুমহীন রাত,প্রেস ক্লাবের সামনে দিন-রাত কাটানো,এমনকি আত্মহুতি।২০২০ সালে শিক্ষক রফিকুল ইসলাম আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগেও অনেকে রোগে-শোকে অনাহারে থেকে প্রাণ হারিয়েছেন। শিক্ষকদের এই আত্মত্যাগ কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য হতে পারে না।
রাষ্ট্র যদি চিকিৎসক, পুলিশ, আমলা, সেনা সদস্যদের যথাযথ সম্মান ও সুবিধা দিতে পারে— তবে জাতি গঠনের মূল কারিগর, একজন শিক্ষকের বেলায় এত অবহেলা কেন?জাতীয় বাজেটে অন্য সব খাতে ব্যয় বাড়লেও, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বরাবরই সীমিত। এমপিওভুক্তির বিষয়টিকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অনেক সময় সরকার শিক্ষকদের প্রতারণা করে।এটাই কি মানবতা?যেখানে একজন শিক্ষক সন্তানকে দুবেলা খাওয়াতে পারেন না, অথচ সেই শিক্ষকই আবার জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি করছেন!শিক্ষক যদি অপমানিত হন, জাতি হয় ধ্বংসের মুখোমুখি। এমপিওভুক্তির মতো একটি মৌলিক অধিকারকে সোনার হরিণ বানিয়ে রাখলে, শিক্ষকতা আর কোনো সম্মানজনক পেশা হিসেবে বিবেচিত হবে না।
যে জাতি শিক্ষকের চোখের জল দেখে না, সেই জাতি কখনোই উন্নত হতে পারে না।আজ প্রয়োজন শিক্ষকদের জন্য সুবিচার,স্বীকৃতি,এবং সংহতি।তবেই আমরা বলতে পারব “মানবতা এখনও বেঁচে আছে”।